আজ মঙ্গলবার, ২রা আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৭ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

অচল অফিসে সচল দালাল চক্র !

স্টাফ রিপোর্টার :
দুর্বৃত্তদের দেয়া আগুনে অচল হয়ে পড়েছে নারায়ণগঞ্জের পাসপোর্ট অফিস। বন্ধ রয়েছে সকল কার্যক্রম। আগুনে পোড়া সেই অচল অফিসকে পুঁজি করেও দৌরাত্ম চালিয়ে যাচ্ছে দালাল চক্র। নিজ নিজ পাসপোর্টের তথ্য জানতে গ্রাহকরা কার্যালয় ঘেঁষা ফটোকপির দোকানগুলোতে গেলে সেখান থেকে দালালদের খপ্পরে পড়ছেন। হাতে পাসপোর্ট পাইয়ে দেয়ার আশ^াস দিয়ে দালালরা একেক জন গ্রাহকের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছেন দুই হাজার টাকা করে। অনেকে নিরুপায় হয়ে স্বরল বিশ^াসে দালালদের হাতে টাকাও দিচ্ছেন। আবার সচেতন গ্রাহকদেরকে এর প্রতিবাদও করতে দেখা গেছে।

জানা গেছে, কোটা ইস্যুতে ভর করে দুর্বৃত্তরা নারায়ণগঞ্জের পাসপোর্ট অফিসে ব্যপক হামলা চালায়। ৪ তলা ভবনের প্রতিটি তলাতেই দেয়া হয়েছে আগুন। এতে ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে নারায়ণগঞ্জের পাসপোর্ট অফিস। গত ১৮ জুলাই দিবাগত রাতে এবং ১৯ জুলাই সকালে ভূঁইঘড়ে অবস্থিত পাসপোর্ট অফিসে দুই দফায় অগ্নিসংযোগ ও হামলা চালায় দূর্বৃত্তরা। এতে পুড়ে গেছে সাড়ে সাত হাজার তৈরীকৃত পাসপোর্ট। একই সাথে অসংখ্য আবেদনকৃত পাসপোর্টের কাগজপত্র পুড়ে ছাই হয়েছে। পুড়ে অঙ্গার হয়েছে পাসপোর্ট অফিসের সার্ভারও। এতে পাসপোর্ট অফিসের কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে।

এদিকে, সাধারণ গ্রাহকরা তাদের পাসপোর্টের বিষয়ে খোঁজ খবর নিতে পাসপোর্ট অফিসের কার্যালয়ে ভির করছেন এবং অফিস সংলগ্ন ফটোকপির দোকানগুলোতে গিয়ে অনলাইনের মাধ্যমে তাদের পাসপোর্টের তথ্য জানার চেষ্টা করছেন। এতেই দালালদের খপ্পরে পরছেন বহু গ্রাহক।

সরেজমিনে দেখা গেছে, পাসপোর্ট অফিস ঘিরে গড়ে উঠেছে প্রায় ২০টির মত কম্পিউটার কম্পোজ ও ফটোকপির দোকান। এর মধ্যে পাসপোর্ট অফিসের গেইট ও সীমানা ঘেঁষে নির্মাণ করা হয়েছে একটি মার্কেট সাদৃশ্য স্থাপনা। যার পুরোটিতেই বিভিন্ন নামে বেনামে একেকটি কম্পিউটার কম্পোজ ও ফটোকপির দোকান করা হয়েছে। এছাড়া, দক্ষিণ পাশে রয়েছে রঘুনাথপুর সড়ক। সড়কটির মাথায় সিরিয়াল ধরে গড়ে উঠেছে আরো বেশ কয়েকটি ফটোকপির দোকানপাট। এমনকি চা-পানের দোকানীরাও রেখেছেন ফটোকপির মেশিন, কম্পিউটার, প্রিন্টার। সেখানে পাসপোর্ট সংক্রান্ত হরেক রকম লিফলেটও লাগিয়েছেন দোকানীরা।

গ্রাহকদের দেয়া তথ্য মতে, প্রতিটি দোকানই যেন একেকটি দালালের চেম্বার। যেখানে পাসপোর্ট সংক্রান্ত কোন কাজে গেলেই গ্রহীতাদের ফাঁদে ফেলে থাকে দালালরা। দ্রুত কাজ বাগিয়ে দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে অতিরিক্ত টাকা।

সহিংসতা ও নৈরাজ্যে পাসপোর্ট অফিস ভঙ্গুর হলেও ওই দালাল চক্রটি সক্রিয় রয়েছে। গতকাল পাসপোর্ট অফিসের সামনে গিয়ে দেখা যায়, আবেদনকারীরা অনলাইনে তথ্য সংগ্রহের জন্য পাসপোর্ট অফিস সংলগ্ন কম্পিউটার কম্পোজ ও ফটোকপির দোকানগুলোতে গেলে দোকানে থাকা দালালচক্র হাতে পাসপোর্ট পাইয়ে দেয়ার কথা বলে ২ হাজার টাকা করে আদায় করছে।

কল্পনা বেগম নামে এক গ্রাহক দৈনিক সংবাদচর্চাকে বলেন, আমি চিকিৎসার জন্য দেশের বাহিরে যাওয়ার প্রয়োজনে পাসপোর্টের আবেদন করেছি। শুনেছি আমার পাসপোর্ট তৈরী হয়ে গেছে। কিন্তু সহিংসতার ঘটনায় পাসপোর্টটি আগুনে পুড়ে গেছে। আজ (গতকাল) পাসপোর্ট অফিসে আসলে পাশর্^বর্তী ‘সেবা কম্পিউটার’ নামক দোকান থেকে অনলাইনে সার্চ দিয়ে পাসপোর্টের তথ্য জানতে গেলে দোকানের মালিক পরিচয় দেয়া এক ব্যক্তি আমার কাছে ২ হাজার টাকা চেয়ে বলেন, তাকে দুই হাজার টাকা দিলে তিনি আমার পাসপোর্ট এনে দিবেন। আমার মত যেসকল গ্রাহক এসকল দোকানে যাচ্ছে, তাদের সবার কাছ থেকেই এভাবে টাকা চাচ্ছে। অনেকে তাদের কথা মত টাকাও দিচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘যেখানে পাসপোর্ট অফিসের কোনো কার্যক্রম চলছে না, পাসপোর্ট পুড়ে গেছে, সেখানে এই দালালরা কিভাবে টাকার মাধ্যমে পাসপোর্ট পাইয়ে দিবে!’

এদিকে, পোসপোর্ট অফিসের পাশে গড়ে উঠা এসকল কম্পিউটার কম্পোজের দোকানগুলোতে যে দালালের আখড়া রয়েছে, তা স্বীকার করে নারায়ণগঞ্জ পাসপোর্ট অফিসের উপ-পরিচালক গাজী মাহমুদুল হাসান দৈনিক সংবাদচর্চাকে বলেন, ‘আমি নারায়ণগঞ্জের পাসপোর্ট অফিসের দায়িত্বে আসার পরই জানতে পেরেছি যে, এসকল দোকানগুলোতে দালালদের আখড়া রয়েছে। তাই এই সকল দোকানীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসক মহোদয়ের কাছে একাধিকবার চিঠি দিয়েছি। ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার আমার নেই। তাই জেলা প্রশাসক মহোদয়ের কাছে চিঠি দিয়েছি যেন মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে ব্যবস্থা নেয়া হয়। এই দলাল চক্রের বিরুদ্ধে যেন ব্যবস্থা নেয়া হয়- সেই বিষয়ে আমি আমার জায়গা থেকে তৎপর রয়েছি। বেশ কয়েকবার মোবাইল কোর্ট পরিচালনাও হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে গোয়েন্দা পুলিশ এবং র‌্যাবের পক্ষ থেকে দোকানগুলোতে অভিযান চালানো হয়েছে। এই দোকানগুলো যেন এখানে না থাকে- সেই জন্য জেলা প্রশাসক মহোদয় আমার দেয়া চিঠির ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন বলে আমি আশাবাদি।’

এক প্রশ্নের জবাবে গাজী মাহমুদুল হাসান বলেন, ‘পাসপোর্ট অফিসের ভেতরে নানা ধরনের সচেতনামূলক পোস্টার ও ব্যানার লাগিয়েছি। এর মধ্যে রয়েছে ‘দালাল হতে সাবধান’ ‘ওরা প্রতারক ও ভণ্ড ওদের ধরিয়ে দিন’ ‘নিজের পাসপোর্ট আবেদন নিজে করি, দালালমুক্ত দেশ গড়ি’ ‘সঠিক ঠিকানা অনুযায়ী ই-পাসপোর্টের আবেদন করুন’সহ নানা নির্দেশনা সংবলিত ব্যানার ও পোষ্টার পুরো পাসপোর্ট অফিসের ভবন জুড়েই লাগানো হয়েছে। যেন সেবাগ্রহীতারা সচেতন হয়।’